দুই বা ততোধিক পদ মিলিত হয়ে এক পদে পরিণত হওয়াকে সমাস বলে। সমাস কথাটির অর্থসংক্ষেপণ বা একাধিক পদের একপদীকরণ। অর্থের দিক থেকে মিল আছে এমন দুই বা ততোধিক শব্দ মিলে একটি শব্দ হওয়ার প্রক্রিয়াকে সমাস বলে। বাক্যে শব্দের ব্যবহার সংক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে সমাসের সৃষ্টি। সমাস দ্বারা দুই বা ততোধিক শব্দের সমন্বয়ে নতুন অর্থবোধক পদ সৃষ্টি হয়।
ভাষাতত্ত্ববিদগণ নানাভাবে সমাস এর সংজ্ঞায়ন করেছেনপরস্পর সম্পর্কিত দুই বা তার বেশি শব্দ একসঙ্গে মিলে সমাস হয়।
পরস্পর অন্বয়যুক্ত দুই বা ততোধিক পদের সামষ্টিক রূপ সমাস ।
যেমন- বটের তলা= বটতলা; একদিকে চোখ যার= একচোখা; সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ ইত্যাদি।
সমাস ছয় প্রকার :
১. দ্বন্দ্ব সমাস
২. দ্বিগু সমাস
৩. কর্মধারয় সমাস
৪. তৎপুরুষ সমাস
৫. অব্যয়ীভাব সমাস
৬. বহৃব্রীহি সমাস।
দ্বন্দ্ব সমাস: যে সমাসে দুই বা ততোধিক পদের মিলন হয় এবং সমস্যমান পদের অর্থপ্রধান থাকে তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন: মা ও বাবা = মা-বাবা; দা ও কুমড়া= দা-কুমড়া; জন্ম ও মৃত্যু= জন্ম-মৃত্যু।
দ্বন্দ্ব সমাস উদাহরণ
সাধারণ দ্বন্দ্ব মা ও বাবা = মা-বাবা
দুই বা ততোধিক পদের
একত্র অবস্থানে সৃষ্ট দ্বন্দ্ব
সমাসকে সাধারণ দ্বন্দ্ব
সমাস বলে।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
মিলনার্থক দ্বন্দ্ব ভাই ও বোন = ভাই-বোন
একাদিক পদের মিলন
আছে এমন বোঝালে তাকে
মিলনার্থক দ্বন্দ্ব বল
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বিরোধার্থক দ্বন্দ্ব সাদা ও কালো = সাদা-কালো
পূর্বপদ ও পরপদের
মধ্যে বিরোধ ভাব
প্রকাশ পাব
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সমার্থক দ্বন্দ্ব হাট ও বাজার = হাট-বাজার
পূর্বপদ ও পরপদের
মধ্যে একই অর্থপ্রকাশ
পাবে
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বহুপদী দ্বন্দ্ব সে , তুমি ও আমি = আমরা
তিন বা বহুপদ মিলে
যে দ্বন্দ্ব সমাস হয়
তাকে বহুপদী দ্বন্দ্ব বল
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ইত্যাদি অর্থে দ্বন্দ্ব কাপড় ও চোপড় = কাপড়চোপড়
একটি শব্দের পিঠে
অপর একটি শব্দ চলে
আসে এবং প্রায়
সম অর্থপ্রকাশ কর
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
অলুক দ্বন্দ্ব দুধে ও ভাতে = দুধেভাতে
যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান
পদগুলোর বিভক্তি লুপ্ত না
হয়ে সমস্ত পদেও বিভক্তি
যুক্ত থাকে তাকে অলুক দ্বন্দ্ব বলে
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
একশেষ দ্বন্দ্ব জায়া ও পতি = দম্পতি
ব্যাসবাক্যের অন্য পদ লোপ
পেয়ে শেষপদ অনুসারে
সমস্তপদ গঠিত হয় তাকে
একশেষ দ্বন্দ্ব বল
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
সংখ্যাবাচক দ্বন্দ নয় ও ছয়= নয়-ছয়
পূর্ব ও পরপদে সংখ্যাবাচক
শব্দ ব্যবহৃত হব
---------------------------------------------------------------------------------------------------------------
দ্বিগু সমাস: যে সমাসের পূর্ব পদে সংখ্যাবাচক শব্দ সমাহার বা মিলন অর্থেথাকে এবং তারপর বিশেষ্য পদের সঙ্গে মিলে যে সমাস হয় তাকে দ্বিগু সমাস বলে। যেমন: চৌ রাস্তার সমাহার = চৌরাস্তা; তিন মাথার সমাহার= তেমাথা; সপ্ত অহের সমাহার= সপ্তাহ।
কর্মধারয় সমাস: যেখানে বিশেষণ বা বিশেষণভাবাপন্ন পদের সঙ্গে বিশেষ্য বা বিশেষ্যভাবাপন্ন পদের সমাস হয় এবং পরপদের অর্থপ্রধান থাকে তাকে কর্মধারয় সমাস বলে। যেমন: যিনি দাদা তিনি সাহেব= দাদা-সাহেব; মহান যে নবী = মহানবী; সিংহ চিহ্নিত আসন= সিংহাসন। কর্মধারায় সমাসের প্রকারভেদ
ক.মধ্যপদলোপী কর্মধারায়
মধ্যপদলোপী কর্মধারায় সমাসের ব্যাসবাক্যে একটি মধ্যপদের আগমন আগমন ঘটে এবং এই মধ্যপদটি সমস্তপদে লোপ পায়। তবে মনে রাখতে হবে, এই মধ্যপদটি কী হবে তা ঠিক করতে হয় সাধারণ বিচারবুদ্ধি দিয়ে; এর কোনো নিয়ম নেই।
উদাহরণ :
পল মিশ্রিত অন্ন = পলান্ন,
জ্যোৎস্না শোভিত রাত = জ্যোৎস্নারাত
পল মিশ্রিত অন্ন = পলান্ন
হাসি মাখা মুখ = হাসিমুখ
চালে ধরে যেন কুমড়া = চালকুমড়া
ক্ষুধিত যে পাষাণ = ক্ষুধিত পাষা
খ. উপমান কর্মধারয় সমাসঃ উপমান অর্থ তুলনীয় বস্তু। প্রত্যক্ষ কোনাে বস্তুর সাথে পরােক্ষ কোনাে বস্তুর তুলনা করলে প্রত্যক্ষ বস্তুটিকে বলা হয় উপমেয়, আর যার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে তাকে বলা হয় উপমান। উপমান ও উপমেয়ের একটি সাধারণ ধর্ম থাকবে। যেমনঃ ভ্রমরের ন্যায় কৃষ্ণ কেশ = ভ্রমরকৃষ্ণকেশ। এখানে ভ্রমর উপমান এবং কেশ উপমেয়। কৃষ্ণ হলাে সাধারণ ধর্ম। সাধারণ ধর্মবাচক পদের সাথে উপমানবাচক পদের যে সমাস হয়, তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে। যেমনঃ তুষারের ন্যায় শুভ্র = তুষারশুভ্র, অরুণের ন্যায় রাঙা = অরুণরাঙা। অন্যভাবে বলা যায়, পূর্বপদে উপমান-বিশেষ্য ও পরপদে সাধারণ গুণবাচক বিশেষণ মিলে যে সমাস হয় তাকে উপমান সমাস বলে।
গ. উপমিত কর্মধারয় সমাসঃ সাধারণ গুণের উল্লেখ না করে উপমেয় পদের সাথে উপমানের যে সমাস হয়, তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। এক্ষেত্রে সাধারণ গুণটিকে অনুমান করে নেওয়া হয়। অন্যভাবে বলা যায়, পূর্বপদে উপমানবিশেষ্য ও পরপদে উপমিত-বিশেষ্য মিলে যে সমাস হয় তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে। যেমনঃ মুখ চন্দ্রের ন্যায় = চন্দ্রমুখ। পুরুষ সিংহের ন্যায় = সিংহপুরুষ।
উপমিত কর্মধারয় সমাসে উপমেয় পদটি পূর্বে বসে।
ব্যাসবাক্যের দুটি পদই বিশেষ্য হয়।
ঘ. রূপক কর্মধারয় সমাসঃ পূর্বপদ উপমেয়-বিশেষ্য ও পরপদ উপমান-বিশেষ্যের মধ্যে অভিন্নতা কল্পনা করে যে সমাস হয় তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। যেমনঃ বিষাদ রূপ সিন্ধু = বিষাদসিন্ধুমন, রূপ মাঝি = মনমাঝি
রূপক কর্মধারয় সমাস এর গঠনঃ
উপমান ও উপমেয়ের মধ্যে অভিন্নতা কল্পনা করা হলে রূপক কর্মধারয় সমাস হয়। এ সমাসে উপমেয় পদ পূর্বে বসে এবং উপমান পদ পরে বসে এবং সমস্যমান পদে ‘রূপ’ যােগ করে ব্যাসবাক্য গঠন করা হয়। যেমনঃ ক্রোধ রূপ অনল = ক্রোধানল।
আরও কয়েক ধরনের কর্মধারয় সমাস রয়েছে। কখনাে কখনাে সর্বনাম, সংখ্যাবাচক শব্দ এবং উপসর্গ আগে বসে পরপদের সাথে কর্মধারয় সমাস গঠন করতে পারে। যেমনঃ অব্যয় : কুকর্ম, যথাযােগ্য। সর্বনাম : সেকাল, একাল। সংখ্যাবাচক শব্দ : একজন, দোতলা। উপসর্গ : বিকাল, সকাল, বিদেশ, বেসুর।
তৎপুরুষ সমাস: পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পেয়ে যে সমাস হয় এবং যে সমাসের পরপদের অর্থপ্রধান থাকে তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। যেমন: মধুদিয়ে মাখা= মধুমাখা; মেঘ থেকে মুক্ত= মেঘমুক্ত।
তৎপুরুষ সমাস নয় প্রকার।
দ্বিতীয়া তৎপুরুষ
তৃতীয়া তৎপুরুষ
চতুর্থী তৎপুরুষ
পঞ্চমী তৎপুরুষ
ষষ্ঠী তৎপুরুষ
সপ্তমী তৎপুরুষ
নঞ তৎপুরুষ
উপপদ তৎপুরুষ
অলুক তৎপুরুষ সমাস
১. দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস কাকে বলে?
যে সমাসে পূর্বপদে দ্বিতীয়া বিভক্তি লোপ পায় তাকে দ্বিতীয়া তৎপুরুষ সমাস বলে।
উদাহরণ : পদকে আশ্রিত = পদাশ্রিত
চরণকে আশ্রিত = চরণাশ্রিত
বিপদকে আপন্ন = বিপদাপন্ন। ধর্মকে সংক্রান্ত = ধর্মসংক্রান্ত
২. তৃতীয়া তৎপুরুষ সমাস কাকে বলে?
পূর্বপদে তৃতীয়া বিভক্তি লোপ পায়।
উদাহরণ : উেঁকি দ্বারা ছাঁটা = চেঁকিছাঁটা
ঘি দিয়ে ভাজা = ঘিয়েভাজা
৩. চতুর্থী তৎপুরুষ সমাস কাকে বলে?
পূর্বপদে চতুর্থী বিভক্তি লোপ পায়। সাধারণত তরে, জন্য, নিমিত্ত বিভক্তিগুলো লোপ পায়।
উদাহরণ : বিয়ের জন্য পাগলা = বিয়েপাগলা
শয়নের নিমিত্তে কক্ষ = শয়নকক্ষ
৪. পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস কাকে বলে ?
পূর্বপদে পঞ্চমী বিভক্তি লোপ পায়। সাধারণত পুত, জাত, আগত, ভীত, গৃহীত, নিয়ত, মুক্ত, উত্তীর্ণ, চালানো, ভ্রষ্ট ইত্যাদি পরস্পরের ফলে পঞ্চমী তৎপুরুষ সমাস হয়।
উদাহরণ : আগা থেকে গোড়া = আগাগোড়া
জেল থেকে খালাস = জেলখালাস
বিলাত হতে ফেরত = বিলাতফেরত
প্রাণের চেয়ে প্রিয় = প্রাণপ্রিয়।
৫. ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস কাকে বলে ?
পূর্বপদে ষষ্ঠী বিভক্তি লোপ পায়।
উদাহরণ : কবিদের গুরু = কবিগুরু
মনের রথ = মনোরথ
খেয়ার ঘাট = খেয়াঘাট
নাটকের অভিনয় = নাট্যাভিনয়
৬. সপ্তমী তৎপুরুষ সমাস কাকে বলে ?
পূর্বপদে সপ্তমী বিভক্তি লোপ পায়।
উদাহরণ : গোলায় ভরা = গোলাভরা
গাছে পাকা = গাছপাকা
অকালে পক্ক = অকালপক্ক
বিশ্বের বিখ্যাত = বিশ্ববিখ্যাত।
৭. নঞ তৎপুরুষ ও নঞ অব্যয়ঃ (না, নেই, নাই, নয়) পূর্বে বসে।
উদাহরণ : নয় সুখ = অসুখ
ন আচার = অনাচার
নয় অতি দীর্ঘ = নাতিদীর্ঘ
নাই বৃষ্টি = অনাবৃষ্টি
৮. উপপদ তৎপুরুষ
কৃৎপ্রত্যয় সাধিত পদ হল কৃদন্তপদ। কৃদন্তপদ-পূর্ব বিশেষ্যকে বলে উপপদ। উপপদের সাথে কৃদন্ত পদের যে সমাস হয় তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে।
উদাহরণ : জলে চরে যে = জলচর
স্থলে চলে যে = স্থলচর
মধু পান করে যে = মধুপ
যাদু করে যে = যাদুকর
৯. অলুক তৎপুরুষ সমাস
যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদে বিভক্তি লোপ পায়, তাকে অলুক তৎপুরুষ সমাস বলে।
উদাহরণ : হাতে কাটা = হাতকাটা
তেলে ভাজা = তেলেভাজা
পড়ার জন্য ঘর = পড়ারঘর
ঘানির তেল = ঘানিরতেল
অব্যয়ীভাব সমাস: যে সমাসে পূর্বপদে অব্যয় থাকে এবং অব্যয়ের অর্ধপ্রধান হয় তাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। যেমন: কূলের সমীপে= উপকূল; গ্রহের ক্ষুদ্র= উপগ্রহ; মরণ পর্যন্ত= আমরণ।
অব্যয়ীভাব সমাস কত প্রকার প্রশ্ন টি তা নয়। অব্যয়ীভাব সমাস মূলত বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। নিচে ব্যবহারের দিক থেকে অব্যয়ীভাব সমাসের ৮টি ভাগ তুলে ধরা হল।
১. যোগ্যতা অর্থে : গুণের যোগ্য = অনুগুণ ।
রূপের যোগ্য = অনুরূপ
প্রেরণার যোগ্য = অনুপ্রেরণা
ভাবের যোগ্য = অনুভব
২. বীপ্সা (অনু, প্রতি) : রোজ রোজ = হররোজ
দিন দিন = প্রতিদিন
ক্ষণ ক্ষণ = অনুক্ষণ
ক্ষণ ক্ষণ = প্রতিক্ষণ
৩. অভাব (নিঃ নির) : ভিক্ষার অভাব = দুর্ভিক্ষ
জলের অভাব = নির্জল
৪. পর্যন্ত (আ) : পা থেকে মাথা পর্যন্ত = আপাদমস্তক।
সমুদ্র থেকে হিমাচল পর্যন্ত = আসমুদ্রহিমাচল
কণ্ঠ পর্যন্ত = আকণ্ঠ জীবন পর্যন্ত = আজীবন
৫. সাদৃশ্য (উপ) : বনের সদৃশ = উপবন
দ্বীপের সদৃশ = উপদ্বীপ
৬. অনতিক্রম্যতা (যথা) :
সাধ্যকে অতিক্রম না করে = যথাসাধ্য
রীতিকে অতিক্রম না করে = যথারীতি
৭. অতিক্রান্ত (উৎ) :
বেলাকে অতিক্রান্ত = উদ্বেল
শৃখলাকে অতিক্রান্ত = উচ্ছল
৮. বিরোধ (প্রতি): বিরুদ্ধ কূল = প্রতিকূল
বিরুদ্ধ বাদ = প্রতিবাদ
৯. পশ্চাৎ (অনু) : গমনের পশ্চাৎ = অনুগমন
তাপের পশ্চাৎ = অনুতাপ
ক্রমের পশ্চাৎ = অনুক্রম
ধাবনের পশ্চাৎ = অনুধাবন
১০. ঈষৎ (আ) : ঈষৎ নত = আনত
ঈষৎ রক্তিম = আরক্তিম
ঈষৎ লাল = ফিকা লাল
১১. ক্ষুদ্র অর্থে : ক্ষুদ্র শাখা = প্রশাখা।
ক্ষুদ্র অঙ্গ = প্রত্যঙ্গ
ক্ষুদ্র বিভাগ = উপবিভাগ
ক্ষুদ্র নদী = শাখানদী
বহুব্রীহি সমাস: যে সমাসে পর্বপদ বা পরপদের কোন অর্থনা বুঝিয়ে তৃতীয় কোনো অর্থপ্রকাশ করে তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে। যেমন: আশিতে বিষ যার= আশীবিষ; নীল কণ্ঠ যার= নীলকণ্ঠ; ঘরের দিকে মুখ যার= ঘরমূখ
0 মন্তব্যসমূহ
please do not enter any spam link in the comment box .
Emoji